স্টাফ রিপোর্টার
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন-বিরোধীদের বড় ধরনের খেলা খেলতে চাওয়া ব্যর্থতায় পরিণত হয়েছে মন্তব্য করে ষড়যন্ত্রকারীদের সুযোগ না দিতে নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের একদিন পর মঙ্গলবার (৯ জানুয়ারি) গণভবনে নেতাকর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে গিয়ে এ মন্তব্য করেন তিনি।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশ করে দলের সভাপতি বলেন, এই নির্বাচন নিয়ে তারা বড় খেলা খেলতে চেয়েছিল। সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আর ব্যর্থ যারা হয়, তাদের মধ্যে একটা প্রতিহিংসা জাগ্রত হয়। আপনারা কোথাও যদি এতটুকু গোলমাল করেন, তাহলে ওই সুযোগটা চক্রান্তকারীরা নিতে চেষ্টা করবে।
নেতাকর্মীদের নিজেদের মধ্যে কোনপ্রকার দ্বন্দ্বে না জড়ানোর নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, এরপর যেন কোথাও কোনরকম, কারও সাথে কোনও দ্বন্দ্ব, কোনকিছু না হয়। যারা জয়ী হয়েছেন সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন। সেটা অন্য দল বা স্বতন্ত্র, সকলে মিলে এখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে হবে।
‘এটা মনে রাখতে হবে, পেছনে কিন্তু শত্রু লেগে আছে। এরা মানুষ পোড়ানো থেকে শুরু করে এমন কোনও জঘন্য কাজ নেই, তারা করে না। কাজেই শিক্ষা নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের মানুষ সাধারণ যে ম্যান্ডেট দিয়েছে, সেটা মেনে নিয়ে সকলকে আগামী দিনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, অনেককে নমিনেশন দিয়েছিলাম। আশা করেছিলাম, তারা জয়ী হবে। কিন্তু পারেননি। জনগণ ভোট দিয়েছেন, সেখানে করার কিছু নেই। জনগণ তাদের ভোট দিয়েছে। জনগণ যেহেতু ভোট দিয়েছেন, সেহেতু কোনও ক্ষোভ নেই। ক্ষোভ যেন না থাকে। সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থাটা ধরে রাখতে হবে।
‘এখানে কোনপ্রকার সংঘাত আমরা দেখতে চাই না। যা কিছু হয়েছে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত। যেহেতু জনগণ ভোট দিয়েছেন, সুতরাং এখানে কারও কোনও অভিযোগ-অনুযোগ থাকার কথা থাকে না। জনগণের ওপর আস্থা-বিশ্বাস রাখতে হবে। ভোট না দিলেও তার কাছে যেতে হবে, বলতে হবে এবং তাদের জন্যই আমাদের কাজ করতে হবে। এই কথাটি মনে রাখতে হবে।’
এ সময় সংসদে থাকা এবং সংসদের বাইরে থাকা সব নেতাদের নিজের সামর্থ্যের সবটুকু ঢেলে দিয়ে মানুষের জন্য কাজ করার, তাদের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশও দেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।
নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণই শেষ কথা মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওদের (বিএনপি-জামায়াত) হাত থেকে কিন্তু কেউ রেহাই পায়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, প্রধান বিচারপতি ও বিচারপতিদের কোয়ার্টার আর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তো সবসময়ই তাদের শিকার। তাদের ভয়াল চেহারা যখন মানুষ দেখেছে, তখন বিএনপিকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। কাজেই তারা নির্বাচনে আসে নাই বলে, কিছুই যায় আসে নাই। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন।
‘ওরা চক্রান্ত করছিল, এই নির্বাচন কিছুতেই হতে দেবে না। আমরা কিন্তু বিকল্প পথ নিয়েছিলাম। আমরা নির্বাচন উন্মুক্ত করে দিয়েছিলাম। স্বতন্ত্র কেউ নির্বাচন করতে চাইলে বা অন্যান্য বিরোধীদল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছেন। আর বলতে পারবে না যে রাতে সিল মেরেছে। কারণ, ব্যালট পেপার রাতে যায়নি। কেন্দ্রে গেছে সকালে। যে কথাটা তারা সারাদিন বলে বেড়াতো, সেটা বলার আর সুযোগ নেই।’
অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আগে নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওপর ন্যস্ত ছিল। আমরা কিন্তু সেটাও সম্পূর্ণ স্বাধীন করে দিয়েছি। এখন আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ হয়। বাজেটে আলাদা অর্থ কমিশনকে দেওয়া হয়, যাতে খরচ করতে পারে। নির্বাচন চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে প্রশাসন, এমনকি একটা বদলিও সরকারের করার কোনও সুযোগ থাকে না।
‘এটা একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই এটা করতে পেরেছি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই আস্থা ও বিশ্বাস আমাদের ওপর আছে। আমরা জনগণের ওপর আস্থা-বিশ্বাস রেখেছি।’
নির্বাচনে নিজের দলের প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কেউ এভাবে ইলেকশন উন্মুক্ত করে দেয় না। আতঙ্কিত থাকতে পারে, যদি সিট কম পায় বা সরকার গঠন করতে না পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের সেই ভয় ছিল না। কারণ, জনগণ যা চাইবে তাই হবে।
‘জনগণ যদি আমাদের ভোট না দেয়, আমরা যদি ক্ষমতায় যেতে না পারি, কোনও দুঃখ নেই। কিন্তু জনগণের ভোটের অধিকার জনগণের হাতে তুলে দিতে পেরেছি সেটাই আমাদের সবচেয়ে আনন্দের বিষয়। আগে ভোটের অধিকার জনগণের হাতে ছিল না, বন্দি ছিল ক্যান্টনমেন্টে। সেটা আমরা এনে দিয়েছি জনগণের হাতে। জনগণ আজ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে।’
শীতের সকাল অপেক্ষা করে ভোটকেন্দ্রগুলোতে বিপুল-সংখ্যক ভোটের উপস্থিতির বিষয়টি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বিশেষ করে নারী যারা, তাদের আমরা ধন্যবাদ জানাই যে, এবারে নির্বাচনে নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত। আমরা যে নারীর ক্ষমতায়নে অনেক কিছু করেছি, এটাই তার প্রমাণ।
আওয়ামী লীগ সরকারে আছে বলেই অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হতে পারে তা প্রমাণ হয়েছে উল্লেখ করে দলীয় সভাপতি বলেন, আমি সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রচার-প্রচারণা চমৎকারভাবে করা হয়েছে। দেশের মানুষের জন্য যে কাজ করেছি, আমাদের সামনে এখন লক্ষ্য হচ্ছে তা এগিয়ে নেওয়া।
এ সময় দেশজ উৎপাদন বাড়ানোর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে। নিজেদের পায়ে নিজেদের দাঁড়াতে হবে। নিজেদের উৎপাদন নিজেরা করতে হবে। অনেকেরই চক্রান্ত ষড়যন্ত্র আছে যে, দুর্ভিক্ষ ঘটাবে, অমুক করবে, তমুক করবে। সেটা যাতে কোনভাবে করতে না পারে, সেজন্য আমাদের এখন থেকেই সচেতন থাকতে হবে।
‘আমাদের উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্য-নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশের উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের চাহিদা মেটানো, বিদেশে রপ্তানি করা, আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলবো। আমাদের দেশের মানুষকে কোথাও যাতে হাত পেতে চলতে না হয়। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে চলবে বাঙালি।’
তিনি বলেন, আমাদের কোনও মাস্টার নেই। বাংলাদেশের জনগণই আমাদের মাস্টার। বাংলাদেশের জনগণই আমাদের শক্তি। আর বাংলাদেশের জনগণ আমাদের আস্থা ও বিশ্বাস। এই বিশ্বাস নিয়েই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
২০৪১ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন করার লক্ষ্যের কথা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা বলেন, নানা ধরনের ষড়যন্ত্র হয়েছে, নির্বাচন হতে দেবে না। মুরব্বিদের (বিদেশি) পরামর্শে চললে বাংলাদেশের আর চলা লাগবে না। যদি সৎ পরামর্শ হয়, সেটা ভালো কথা।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, তারা নির্বাচন হতে দেবে না, তাদের কিছু মুরব্বি আছে, বাংলাদেশের মানুষকে তারা চেনে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষকে দাবায় রাখতে পারবে না, ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের মানুষ সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে। আমাদের কোনও প্রভু নেই। বাংলাদেশের জনগণই আমাদের শক্তি।
৭ জানুয়ারির নির্বাচন দেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, ’৭৫-এর পর বাংলাদেশে যত নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্যে এ নির্বাচন সবচেয়ে সুশৃঙ্খল, সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, প্রতিযোগিতামূলক ও অংশগ্রহণমূলক। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ নির্বাচন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
মঞ্চে শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানাও উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এ সময় মঞ্চের দুই পাশে কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।