গাজীপুরে রেল লাইনে নাশকতার ঘটনায় জড়িততিনজনের স্বীকারোক্তি

স্টাফ রিপোর্টার
রেল লাইনে নাশকতার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরসহ সাতজনকে গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফপ্তারের পর তাদের রোববার বিকালে ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ ৪ জন রিমান্ড চেয়ে ঢাকা চীফ জুডিশিয়াল মেজিষ্ট্রেট আদালতে পাঠানো আদালতে প্রেরণ করা হয়। আদালত হাসান আজমল ভূঁইয়াসহ চার আসামির প্রত্যেকের তিনদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করে। তাদের মধ্যে তিন জন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। ওই তিনজন হলেন, নেত্রকোণার মদন উপজেলার বারইবাজার এলাকার রফিকুল ইসলামের ছেলে জান্নাতুল ইসলাম (২৩), ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার বান্দীয়া মেদুয়ারি এলাকার তাইজুদ্দিনের ছেলে মেহেদী হাসান (২৫) এবং গাজীপুরের উত্তর ছায়াবিথী এলাকার সোলাইমান মোড়লের ছেলে শাহানুর আলম (৫৩)। ঢাকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জুলহাস উদ্দিনের আদালতে আসামি শাহনুর আলম, সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমানের আদালতে আসামি মেহেদী হাসান ও সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শেখ মুজাহিদুল ইসলামের আদালতে আসামি জান্নাতুল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গাজীপুর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (দক্ষিন) মোহাম্মদ নাজির আহমেদ খান।
গ্রেফপ্তার অন্য চার জন হলেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসান আজমল ভূঁইয়া (৫০), জুলকার নাইন আশরাফি ওরফে হৃদয় (৩৫), সাইদুল ইসলাম (৩২) ও সোহেল রানা (৩৮)। এর মধ্যে হাসান আজমল ভূঁইয়া গাজীপুর সদর থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র। দলীয় সিদ্ধান্তেরর বাইরে গিয়ে গত সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তাঁকে বিএনপি থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হলে তিনি সংবাদ সম্মেলন করে তার প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেন এবং তিনি নিজের ভোট প্রদানের জন্যও কেন্দ্র যাননি। কিন্তু ব্যালটে তার প্রতীক (লাটিম) থাকায় ভোটারগণ তাকে বিপুল ভোট দিয়ে (আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থীর চারগুন) কাউন্সিলর নির্বাচিত করেন। হাসান আজমল ভূইয়ার স্ত্রী গাজী রুনা যুগান্তরকে বলেন, তার স্বামী গাজীপুর পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশনের ৪বারের নির্বাচিত কাউন্সিলর। তিনি এলাকায় খুবই জনপ্রিয় এবং একজন ভাল মানুষ হওয়ায় নির্বাচনে কখনো ফেল কনেননি । তিনি তার স্বামীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অন্যায় করা হচ্ছে বলে, ন্যায় বিচার দাবি করেন।
উল্লেখ্য গত বুধবার ভোরে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের বনখরিয়া এলাকায় আন্তনগর মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। ট্রেনটি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকার কমলাপুরে যাচ্ছিল। মঙ্গলবার রাতের কোনো একসময় গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর ও ভাওয়াল রেলস্টেশনের মাঝামাঝি রেলপথের একটি অংশ কেটে রাখে দুর্বৃত্তরা। এতে ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়ে ১ জন যাত্রী নিহত এবং ১২ জন আহত হয়।
গাজীপুর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (দক্ষিন) উপ-কমিশনার মোহাম্মদ নাজির আহমেদ খান জানান, গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে সাত জনকে গ্রেফপ্তার করা হয়। গ্রেফপ্তারের পর তাদের রেলওয়ে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হলে তারা আসামীদের আদালতে পাঠায়।
এর আগে রোববার দুপুরে গাজীপুর মহানগর পুলিশের প্রধান কাযালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনের গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহবুব আলম বলেছেন, দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের চাপ ও দেশে-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করতে রেললাইনে নাশকতার পরিকল্পনা হয়। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী আটজন মিলে রেললাইনের কিছু অংশ কেটে রাখেন।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন গাজীপুর জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম, গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপার কাজী শফিকুল আলম, গাজীপুর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান, রেলওয়ে পুলিশের এসপি মো. আনোয়ার হোসেনসহ জেলা ও মহানগর পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে আসামিদের আদালতে হাজির করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক মো. সালাহউদ্দিন রিমান্ড ও জবানবন্দি গ্রহণের আবেদনে উল্লেখ করেন, গত ১১ ডিসেম্বর রাতে কাউন্সিলর হাসান আজমল ভূঁইয়ার বাসায় ২৫/৩০ জন দলীয় নেতাকর্মী রেললাইনে নাশকতার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৩ ডিসেম্বর ভোর ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে বনখরিয়া রেললাইনের প্রায় ১৭.৫০ ফুট লাইন কেটে স্থানচ্যুত করে ফেলেন। এতে মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস’ লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। ট্রেনটির ইঞ্জিনসহ সাতটি বগি রেললাইনের ডানে ও বামে পরে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই একজন নিহত হন। ঘটনায় গত ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী পরিচালক আশ্রাফুল আলম খাঁন বাদী হয়ে ঢাকা রেলওয়ে থানায় অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা দায়ের করেন। এরপর ১৬ ডিসেম্বর অভিযান চালিয়ে হাসান আজমল ভূঁইয়াসহ সাত আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। আসামিদের মধ্যে শাহানুর আলম, জান্নাতুল ও মেহেদী হাসান স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিতে চাইলে তা রেকর্ড করতে ও বাকি চার আসামির পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
মামলার এজাহারে বলা হয়, অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজসে নাশকতা করে ট্রেনের যাত্রীদের হত্যা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যাপক ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে বর্ণিত স্থানে প্রায় ২০ ফিট অক্সি-অ্যাসিটিলিন সিলিন্ডার ও এলপিজি সিলিন্ডারের মাধ্যমে গ্যাস কাটার দিয়ে কেটে রেললাইনটি বিচ্ছিন্ন করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *