স্টাফ রিপোর্টার
১৪ মে গাজীপুরের বাড়ীয়া গ্রামে ভয়াবহ গণহত্যা দিবস। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ শহিদের সঙ্গে বাড়ীয়া গ্রামের গণহত্যা এক বিভিষিকাময় অধ্যায়। ঢাকার নিকটবর্তী গাজীপুর জেলার মধ্যে এটিই ছিল সবচেয়ে নৃশংসতম ব্যাপক গণহত্যা। ১৯৭১ সালের এই দিনে গাজীপুর সদর উপজেলার সনাতন ধর্মাবলম্বীসমৃদ্ধ বাড়ীয়া গ্রামে এলাকার কিছু রাজাকারের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাড়ীয়া গ্রামে হামলা চালিয়ে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে কয়েকশত নারী-পুরুষ, শিশু নির্মমভাবে হত্যা করে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে সেদিন উক্ত গ্রামে প্রায় তিন শতাধিক গ্রামবাসী নিহত হয়। তাছাড়া তিন-চারশত গ্রামবাসী আহত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের দোসর-রাজাকারদের সহায়তায় গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে হামল, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ চালায়। বাড়ীয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক সেনা সদস্য বিজয় দাস জানান, ১৯৭১ সালের ১৪ মে (১৩৭৮ সালের ২৯ বৈশাখ) শুক্রবার দুপুর একটার দিকে স্থানীয় রাজাকার আউয়ালসহ আরো বেশকিছু রাজাকারের সহায়তায় গাজীপুর শহরের জয়দেবপুর ভাওয়াল রাজবাড়ী সেনানিবাস থেকে দুই শতাধিক বর্বর পাকিস্তানি সেনা সদস্য বাড়ীয়া গ্রামে হামলা চালায়। জয়দেবপুর থেকে আট কিলোমিটার পূর্বে বাড়ীয়া গ্রামে ঢুকেই সেনা সদস্যরা চারিদিকে ছড়িয়ে পরে। এরপর তারা নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। তাদের এই বর্বরোচিত হামলায় বাড়ীয়া ও পাশর্^বর্তী কামারিয়া গ্রামের লোকজন ভয়ে-আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে থাকে। কেউ কেউ পালাতে পারলেও পাকিস্তানি সেনাদের নির্বিচারে অবিরাম গুলিবর্ষণে শত শত নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ নিহত ও আহত হয়। হামলার শিকার গ্রামবাসীদের আর্তচিৎকারে এক বিভিষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। অনেকে তাৎক্ষণাৎ মারা যায়, অনেকে আহত হয়ে কাতরাতে থাকে। অনেকেই পাশর্^বর্তী বেলাই বিলে লুকাতে এবং সাতরায়ে অথবা নৌকা যোগে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে তাদের উপরও নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করা হয়। ফলে এখানেও অনেকে নিহত ও আহত হয়। বাড়ীয়া গ্রামটি সনাতন ধর্মাবলম্বী-প্রধান ও জয়দেবপুর থেকে অনেকটা দূরবর্তী নিরাপদ এলাকা মনে করে পরিবার-পরিজনসহ বহু লোক এ গ্রামে আশ্রয় নেয়। ফলে এদেরও অধিকাংশ নিহত বা আহত হয়। হামলার পর সাতদিন ভয়ে-আতঙ্কে স্বজনহারা অনেক গ্রামবাসী তাদের বেঁচে থাকা আত্মীয়স্বজনদের দেখতে গ্রামে প্রবেশ করতে পারেনি। তাই হামলায় কতজন স্থানীয় ও অস্থানীয় লোকজন নিহত বা আহত হয়েছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান কেউ জানাতে পারেনি। সেদিন শত শত মানুষ নিহত ও আহতদের রক্তে বাড়ীয়া গ্রামের মাটি ও বেলাই বিলের পানি রক্তাক্ত হয়ে ওঠেছিল। শুধু হামলা করেই পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোশররা ক্ষান্ত হয়নি। তারা বাড়িতে বাড়িতে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, মারপিট ও নারীদের উপর নির্যাতন চালায়। সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের এ হামলা অব্যাহত থাকে। এমন বর্বরোচিত হামলা ও গুলিবর্ষনে শত শত মানুষের মৃত্যুর খবর আশেপাশের গ্রামগুলিতে ছড়িয়ে পড়লে সবার মধ্যে প্রবল আতঙ্ক দেখা দেয়। অনেক পরিবার ভয়ে আরো দূরবর্তী নিরাপদ গ্রামে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে গাজীপুর জেলার বাড়ীয়া গ্রামে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ছিল ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টিকারী প্রথম ঘটনা। মুক্তিযোদ্ধা বিজয় দাস আরো জানান সেদিন এমন বর্বর হামলায় ঠিক কতজন নিহত হয়েছিলেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নিরূপণ করা যায়নি । তবে পাশর্^বর্তী গ্রামসহ বাড়ীয়া গ্রামে আশ্রিত হত্যাকান্ডের শিকার তিন শতাধিক হবে বলে তিনি জানান। তিনি হত্যাকান্ডের শিকার নিহতদের একটি অসম্পূর্ণ তালিক দিয়েছেন। তালিকা অনুযায়ী নিহতরা হচ্ছেন জয়ধনি দাস, সহদেব দাস, হরিচরণ দাস, অক্ষয় কুমার দাস, নগেন্দ্র চক্রবর্তী, ছায়া রাণী দে, করপুলা দাস, সচীন্দ্র চন্দ্র দাস, বিজয় চন্দ্র দাস, সাহাবউদ্দিন ভুইয়া, ছাহেরা বেগম, অদুদ ভূইয়া, ওয়াজেদ ভূইয়া, রোকয়া ভূইয়া, মমতাজ বেগম, হরেন্দ্র চন্দ্র শীল,মনদা সুন্দরী শীল, ভানু চন্দ্র শীল, তরু বালা শীল, দিপালী বালা শীল, মনীন্দ্র চন্দ্র শীল, মালতী রাণী শীল, প্রেমবালা শীল, সত্যরঞ্জন মালী, চারুবালা শীল, রেণুবালা শীল, সাধনা রাণী শীল, জ্ঞানদা রাণী শীল, অবনী চন্দ্র দাস, ভুলু চন্দ্র দাস, ফুলু রাণী দাস, সন্ধ্যা রাণী দাস, কোকারাম দাস, বিপুলা রাণী দাস, শরৎ চন্দ্র দাস, হিরনী রাণী দাস, যামিনী রাণী দাস, চাঁনমোহন দাস, সুখমোহন দাস, মিনা রাণী দাস, দেবেন্দ্র চন্দ্র দাস, ইন্দ্রমোহন দাস, যোগেশ চন্দ্র দাস, বিলাস মনি দাস, বিনদা রাণী দাস, নারায়ণ চন্দ্র দাস, সুন্দরী রাণী দাস, সুখ মনি দাস, সারদা রাণী মন্ডল, হাছুনী রাণী দাস, পার্বতী রাণী দাস, রজনীকান্ত দাস, সবিতা রাণী দাস, বিনদা রাণী দাস, শরৎ চন্দ্র দাস, বীরেন্দ্র চন্দ্র দে, রেখা রাণী দত্ত, অঞ্জলি রাণী দাস, সুচিত্রা সেন, পঞ্চানন্দ সেন, দীপ্তি রাণী রায়, অনিল চন্দ্র রায়, শেফালী রাণী রায়, মো. কফিল উদ্দিন, মো. রমিজ উদ্দিন, মো. চাঁন মিয়া প্রমুখ।
2024-05-13